হুন্ডিতেই বছরে পাচার ৭৫ হাজার কোটি টাকা

প্রবাসীদের পাঠানো আয় (রেমিট্যান্সের) ওপর রিজার্ভ পরিস্থিতি অনেকটা নির্ভরশীল। চলমান ডলার সংকটের মধ্যেও বৈধ চ্যানেলে (মাধ্যমে) আসা রেমিট্যান্স বাড়লে স্বস্তিও বাড়ে।

কাতারে চাকরি খুঁজছেন? এখানে ক্লিক করুন

এসব কারণ বিবেচনায় নিয়ে হুন্ডিসহ সব অবৈধ চ্যানেলে প্রবাসী আয় পাঠানো হার শূন্যে নামাতে নানামুখী উদ্যোগ করা হয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে।

হুন্ডিচক্রকে আইনের আওতায় আনতে নিয়মিত অভিযান অব্যাহত রেখেছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) ও আর্থিক গোয়েন্দা সংস্থা বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টিলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিভিন্ন শাখা।

কাতারের সব খবর হোয়াটসঅ্যাপে পেতে চাইলে এখানে ক্লিক করুন

কড়া নজরদারি করা হচ্ছে গ্রাহকদের ব্যাংক ও মোবাইল ব্যাকিং লেনদেনের ওপরেও। তবুও থামছে না হুন্ডিচক্রের দৌরাত্ম্য।

সিআইডি ও বিএফআইইউ সূত্র বলছে, নানাভাবে পাচার হচ্ছে অর্থ। শুধুমাত্র হুন্ডির মাধ্যমেই কমপক্ষে বছরে ৭৫ হাজার কোটি টাকা পাচার হচ্ছে।

সিআইডি বলছে, অনেক ক্ষেত্রেই বাংলাদেশ থেকে অর্থ পাচারের গন্তব্যস্থল সম্পর্কে সঠিক তথ্য পাওয়া যায় না। তবে যেসব দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের ব্যবসা-বাণিজ্য রয়েছে, প্রাথমিকভাবে সেসব দেশে এবং পরবর্তী সময়ে অন্যত্র সুবিধামতো জায়গায় স্থানান্তরিত করা হয়।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বর্তমানে দেশের অর্থনীতির বিষফোঁড়া হলো হুন্ডির মাধ্যমে অর্থ পাচার। প্রবাসীদের আয়ের অর্ধেক টাকা হুন্ডির মাধ্যমে পাঠানোর কারণে পাচার হয়ে যাচ্ছে।

শুধু প্রবাসী আয়ই নয়, আরও নানা খাত থেকে অর্থ পাচার হচ্ছে। হুন্ডি মাধ্যম ছাড়াও আরও বিভিন্ন উপায়ে এসব অর্থ পাচার হচ্ছে। অর্থ পাচার ঠেকাতে সিআইডির অভিযান ও বিভিন্ন কার্যক্রম চলমান রয়েছে।

সিআইডি বলছে, ব্যাঙের ছাতার মতো হাজার হাজার অবৈধ মানি এক্সচেঞ্জার রয়েছে দেশে। এসব মানি এক্সচেঞ্জারদের মাধ্যমে দেশ থেকে বিদেশে অর্থ পাচার করছে দুষ্কৃতিকারীরা। তবে পূর্বের তুলনায় বর্তমানে সিআইডির অর্থ পাচার প্রতিরোধের বিভিন্ন অভিযানে বেশ কিছু সফলতা এসেছে।

সিআইডির দাবি, অর্থ পাচার রোধে যার যার অস্থান থেকে সর্তক থাকতে হবে। কোনো কিছু না বুঝলে আইনের সহযোগিতা নিলে অনেকটা এসব ঝামেলা নিয়ন্ত্রণে চলে আসবে।

সিআইডি থেকে প্রাপ্ত তথ্যে জানা যায়, শুধু হুন্ডি প্রক্রিয়ায় দেশ থেকে বর্তমানে বছরে ৭৫ হাজার কোটি টাকা পাচার হয়ে যাচ্ছে। ২০২০ সালে বিশ্বব্যাপী করোনা মহামারি শুরু হলে হুন্ডি ব্যবসা অনেকটা কমে যায়।

সেজন্য প্রায় দুই বছর বৈধ পথে রেমিট্যান্স আসে এবং ২০২১ সালে আগস্টে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভ সর্বোচ্চ ৪৮ বিলিয়ন ডলার অতিক্রম করে। ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রথম দিক থেকেই করোনা মহামারির প্রকোপ কমে এলে হুন্ডি ব্যবসা আবার চাঙ্গা হয়।

বৈধ পথে রেমিট্যান্স পাঠানো কমে যাওয়ার ফলে ২০২০-২১ অর্থবছরে ২৪ দশমিক ৭৭ বিলিয়ন ডলার থেকে ২০২১-২২ অর্থবছরে ২১ দশমিক শূন্য ৩ বিলিয়ন ডলারে নেমে আসে; যা শতকরা হিসেবে ১৫ শতাংশ কম। শুধু হুন্ডির মাধ্যমেই নয়, আরও নানা উপায়ে দেশ থেকে বৈদেশিক মুদ্রা পাচার হয়।

এদিকে হুন্ডি মাধ্যমে অর্থ পাচারের বিষয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ও উদ্বিগ্ন।

গত বছরের ৪ আগস্ট সরকারি ক্রয়সংক্রান্ত ও অর্থনৈতিক বিষয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির বৈঠক শেষে অর্থমন্ত্রী বলেন, মোট পাঠানো রেমিট্যান্সের ৪৯ শতাংশ আসে হুন্ডির মাধ্যমে। কখনো কখনো এ শতকরা হার আরও বেড়ে যায়। এ প্রক্রিয়ায় পাঠানো বৈদেশিক মুদ্রার সমপরিমাণ বাংলাদেশি টাকা দেশে পরিশোধ করা হয়। বৈদেশিক মুদ্রা হুন্ডি ব্যবসায়ীদের মাধ্যমে বিদেশে পাচার হয়ে যায়।

সিআইডির একটি সূত্র জানায়, অনেক পদ্ধতিতে অর্থ পাচার হয়। তবে এর মধ্যে দুর্নীতিবাজ সামরিক-বেসামরিক আমলা, রাজনীতিবিদ ও অসৎ ব্যবসায়ীরা এসব অর্থ পাচার করেন।

অনেকেই অসৎ উপায়ে অর্জিত টাকা বিদেশে পাঠিয়ে দেন। আমদানি-রপ্তানির আড়ালে একশ্রেণির ব্যবসায়ী বিদেশে উন্নত জীবন কাটানোর কিংবা বিকল্প ব্যবসার উদ্দেশ্যে অর্থ পাচার করেন।

সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাই কিংবা মালয়েশিয়ায় জমি, বাড়ি বা ফ্ল্যাট ক্রয় কিংবা ইংল্যান্ডসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে বসবাসের বিকল্প ব্যবস্থার জন্য অর্থ পাচার করেন। মাদক ও অস্ত্র ব্যবসাসহ অন্যান্য অবৈধ ব্যবসার (যেমন ক্যাসিনো) মাধ্যমে অর্জিত অর্থ বিদেশে নিরাপদে সংরক্ষণের উদ্দেশ্যে পাচার করেন।

উন্নত সুযোগ-সুবিধার জন্য স্ত্রী-সন্তানদের বিদেশে রাখা এবং নিজেও গোপনে ওই দেশের নাগরিক হয়ে ভবিষ্যতে নিরাপত্তার জন্য অর্থ পাচার করে জমা করেন।

এই বিষয়ে সিআইডি প্রধান অতিরিক্ত আইজিপি মোহাম্মদ আলী মিয়া বলেন, ‘পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) গত বছর সেপ্টেম্বরে অবৈধ হুন্ডিচক্রের বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করে। সিআইডির সাইবার পুলিশ সেন্টারের (সিপিসি) একটি দল বেশ কয়েকজন অর্থ পাচারকারীকে গ্রেপ্তার করেছে।’

তিনি বলেন, ‘আমরা বিএফআইইউর (বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট) কাছ থেকে পাওয়া এমএফএসের তথ্যের ভিত্তিতে হুন্ডির সঙ্গে জড়িতদের দেশের বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালিয়ে গ্রেপ্তারের চেষ্টায় আছি। তা ছাড়া অর্থ পাচারকারীদের যাবতীয় তথ্য পর্যালোচনা করে সুনির্দিষ্ট তথ্যেরভিত্তিতে বিদেশে অর্থ পাচারকারীদেরও গ্রেপ্তার করা হবে ‘

এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহকারী অধ্যাপক এবং সমাজ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ তৌহিদুল হক বলেন, ‘দিন দিন অর্থ পাচারের ঘটনা বেড়েই চলছে। অনেক সময় দেখা গেছে পাচারকারীদের গ্রেপ্তার করে ঢালাওভাবে প্রচার করা হচ্ছে। তবে এতে ফল হচ্ছে না। সর্তক হয়নি পাচার চক্র, নির্মূলও হয়নি।’

আরো পড়ুন

Loading...
,