খেতে গিয়ে লাশ পুরো পরিবার, পড়ে রইল ভিসা-পাসপোর্ট

একটি বা দুটি নয়, চারটি লাশবাহী গাড়ি। একটিতে দুই ভাইবোনের কফিন। আর বাকি তিনটিতে তাদের বাবা-মা ও বড় বোনের মৃতদেহ। পাঁচ লাশ নিয়ে গাড়িগুলো রাজধানীর হাতিরঝিলের মধুবাগের স্বপ্নচূড়া ভবনের বেজমেন্টে দাঁড়িয়ে। প্রতিবেশীদের অনুরোধে লাশগুলো আনা হয়েছে সেখানে, তারা শেষবারের মতো একনজর দেখবে বলে।

কাতারে বিভিন্ন কোম্পানিতে নতুন চাকরির খবর

রক্তের সম্পর্ক নয়, দীর্ঘদিনের প্রতিবেশী হওয়ায় ভবনের অপর বাসিন্দাদের আপনজন হয়ে উঠেছিল ইতালি প্রবাসী সৈয়দ মোবারক হোসেন কাউসারের পরিবার। একই পরিবারের পাঁচ লাশ দেখে চোখের পানি ধরে রাখতে পারেননি কেউ। গতকাল শুক্রবার দুপুর ১২টায় সেখানে এক শোকাবহ পরিবেশ সৃষ্টি হয়।

বৃহস্পতিবার রাতে বেইলি রোডের ভবনের আগুনে ইতালি প্রবাসী কাউসার (৫০), তাঁর স্ত্রী স্বপ্না আক্তার (৪২), দুই মেয়ে ফাতেমা তুজ জোহরা কাশফিয়া (১৯) ও আমেনি আক্তার নুর (১৪) এবং একমাত্র ছেলে সৈয়দ আব্দুল্লাহ (৮) প্রাণ হারান। তারা ওই ভবনের কাচ্চি ভাই রেস্তোরাঁয় খেতে গিয়েছিলেন। আর এটিই কাল হলো পরিবারটির।

স্থায়ীভাবে বসবাসের জন্য এ মাসেই স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে ইতালি ফেরার কথা ছিল দেশটির গ্রিনকার্ডধারী কাউসারের। কিন্তু এর আগেই সব শেষ। পরিবারটির আর কেউ বেঁচে রইল না। গতকাল বিকেলে পাঁচ মৃতদেহ গ্রামের বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইল উপজেলার শাহবাজপুরে নিলে সেখানেও সৃষ্টি হয় শোকাবহ পরিবেশ।

কাতারের সব আপডেট পেতে যুক্ত হোন আমাদের হোয়াটসঅ্যাপ চ্যানেলে

নিহত কাউসারের মা হেলেনা বেগম জানিয়েছেন, স্ত্রী ও তিন সন্তান নিয়ে গতকাল শুক্রবার কাউসারের গ্রামের বাড়ি যাওয়ার কথা ছিল। গেলেন ঠিকই, তবে লাশ হয়ে।

স্বজনরা জানিয়েছেন, রাজধানীর মধুবাগের স্বপ্নচূড়া ভবনের বি-৩ নম্বর ফ্ল্যাটটি কাউসারের নিজের। সেখানে স্ত্রী, দুই মেয়ে ও ছেলে থাকতেন। বড় মেয়ে কাশফিয়া মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের দ্বাদশ শ্রেণি আর ছোট মেয়ে আমেনা মধুবাগ বিটিসিএল স্কুলের সপ্তম শ্রেণির ছাত্রী ছিল। ছেলে আব্দুল্লাহ একটি মাদ্রাসার শিক্ষার্থী।

তিন বছর পর গত ২২ জানুয়ারি কাউসার দেশে আসেন। ২৩ মার্চ স্ত্রী ও তিন সন্তানকে ইতালি নিয়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু তার আগেই সব শেষ।

মধুবাগের বাসার নিচে লাশবাহী গাড়ির পাশে দাঁড়িয়ে আর্তনাদ করছিলেন কাউসারের ছোট ভাই সৈয়দ আমীর হামজা। স্বজনরা তাঁকে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করছিলেন।

কাঁদতে কাঁদতে তিনি বলেন, ‘সব শেষ হয়ে গেল। ভাইয়ের কত স্বপ্ন ছিল স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে বিদেশে স্থায়ী হবে। তাদের নিয়ে যাওয়ার সব কার্যক্রম শেষ করেও ফেলেছিলেন। কিন্তু সবাইকে নিয়ে দুনিয়া ছেড়েই চলে গেলেন।’

স্বপ্নচূড়া ভবনের কেয়ারটেকার বাবর আলী জানান, বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার দিকে কাউসার ছেলেমেয়ে ও স্ত্রীকে নিয়ে বাসা থেকে নিচে নামেন। এর পর বাসার সামনে থেকে দুটি রিকশায় তারা বেইলি রোডে যান।

কাউসারের বাবা সৈয়দ আবুল কাশেম প্রায় ২০ বছর আগে মারা গেছেন। তিন ভাই ও এক বোনের মধ্যে কাউসার দ্বিতীয়। চার ভাইবোনের তিনজনই বিদেশে থাকতেন।

তাঁর বড় ভাই সৈয়দ সোয়েব সপরিবারে থাকেন ইতালি এবং একমাত্র বোন হাজেরা পুতুল স্বামী-সন্তান নিয়ে বাস করেন আমেরিকায়। ছোট ভাই সৈয়দ আমীর হামজা থাকেন দেশেই। বেসরকারি একটি ব্যাংকে চাকরি করেন।

কাউসারের চাচাতো ভাই সৈয়দ রিয়াদ জানান, কাউসারের জীবনের বেশির ভাগ সময় কেটেছে বিদেশের মাটিতে। ২০-২২ বছর বয়সে তিনি প্রথমে যান মালয়েশিয়া। সেখান থেকে করেন সিঙ্গাপুরে।

এর পর ২০০৮ সালে ইতালি গিয়ে থিতু হন। সেখানে প্রথম দিকে চাকরি করলেও পরে ব্যবসা শুরু করেন। হোটেল থেকে শুরু করে বিভিন্ন ব্যবসা ছিল তাঁর।

গতকাল সকালে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে পাঁচজনের লাশ বুঝে পান তারা। এর পর মৃতদেহ গোসলের জন্য ধানমন্ডিতে নেওয়া হয়। সেখান থেকে নেওয়া হয় মধুবাগের বাসায়। পরে নিয়ে যাওয়া হয় গ্রামের বাড়ি।

তিন-চার দিন আগে ছেলে কাউসারের সঙ্গে ফোনে কথা হয়েছিল তাঁর মা হেলেনা বেগমের। মাকে তিনি জানিয়েছিলেন, স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে শুক্রবার গ্রামের বাড়িতে যাবেন।

ছেলে, পুত্রবধূ ও নাতি-নাতনির মৃত্যুর খবর শুনে বারবার মূর্ছা যাচ্ছেন বৃদ্ধা হেলেনা বেগম। কাঁদতে কাঁদতে বলেন, ‘আমার ছেলে ঠিকই শুক্রবার বাড়ি আইছে। কিন্তু মা বলে ডাকেনি। নাতিরাও দাদি বলেনি। আমার সব শেষ হইয়া গেছে। তোমরা আমার ছেলেরে আইন্যা দেও, বউমা, নাতিদের আইন্যা দেও।’

শুধু মা হেলেনা বেগমই নন, একই পরিবারের পাঁচ সদস্যের মৃত্যুতে আত্মীয়স্বজনসহ পুরো গ্রাম যেন শোকে স্তব্দ হয়ে গেছে। কারও মুখে কথা সরছিল না। খন্দকারপাড়ার সৈয়দ বাড়িতে চলছে শোকের মাতম।

নিহত কাউসারের স্ত্রীর বড় বোন পলি বেগম জানান, কাউসার ছেলে সৈয়দ আব্দুল্লাহর খতনা সম্পন্ন করেন সম্প্রতি। খতনার সময় ছেলে আবদার করেছিল তাকে কাচ্চি খাওয়াতে হবে। ছেলের আবদার পূরণ করতে কাচ্চি খেতে গিয়েছিলেন তারা।

বিকেল সোয়া ৩টার দিকে চারটি লাশবাহী গাড়িতে পাঁচজনের মৃতদেহ পৌঁছায় গ্রামে।

লাশবাহী গাড়িগুলো ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক হয়ে শাহবাজপুর গ্রামের রাস্তায় সাইরেন বাজিয়ে প্রবেশ করলে গ্রামের শত শত মানুষ ছুটে আসে। বাদ আসর পারিবারিক কবরস্থানে পাঁচজনের লাশ পাশাপাশি দাফন করা হয়।

আরো পড়ুন-

Samakal

Loading...
,